
এক সময় আগুন লাগলে মানুষ দৌড়ে যেত সাহায্য করতে। পাড়ার মানুষ, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি অচেনা পথচারী পর্যন্ত মগ, কলসি, বালতি হাতে ছুটে যেত আগুন নেভাতে। পুকুর, খাল বা জলাশয় থেকে পানি এনে সারি করে আগুনের দিকে দিত। কেউ ভিজানো কাঁথা ছুঁড়ে দিত ঘরের চালায়। তখন ছিল না ফায়ার সার্ভিস, ছিল না আধুনিক যন্ত্রপাতি, কিন্তু ছিল মানবতা। একজনের দুঃখ ছিল সবার দুঃখ। আগুন নেভাতে গিয়ে কেউ আহত হতো, কেউ ঘর হারাত, তবু পাশে থাকত সবাই।
কিন্তু এখন? আগুন লাগলে মানুষ দৌড়ে যায় ঠিকই, তবে হাতে বালতি নয়, থাকে অ্যান্ড্রয়েড ফোন। ফেসবুক লাইভ, ইনস্টাগ্রাম রিলস বা ইউটিউব শর্টস- এই শব্দগুলো এখন মানবিকতার জায়গা দখল করে নিয়েছে। আগুন জ্বলছে, ধোঁয়া উঠছে- কেউ পানি দিচ্ছে না, সবাই ভিডিও করছে। অনেক সময় ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে বিলম্বিত হয় এই ভিড় আর লাইভকারীদের কারণে। কারও চোখে আর আতঙ্ক নেই, আছে কেবল কৌতূহল আর কনটেন্ট তৈরির লোভ। আগুন নিভুক বা মানুষ পুড়ুক- তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ‘লাইভটা ভাইরাল হলো কি না।’ অথচ দুর্ঘটনা মানেই লাইভ নয়, জীবন বাঁচানোর সময়।
একই চিত্র সড়ক দুর্ঘটনায়ও। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৫ হাজারের বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়, আহত হয় প্রায় দেড় লক্ষাধিক (তথ্যসূত্র- সড়ক নিরাপত্তা ফাউন্ডেশন, ২০২৪)। এসব দুর্ঘটনার অনেকগুলোতেই দেখা যায়- লোকজন দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে, ভিডিও করছে, কেউ কেউ লাইভে বলছে- ‘প্রিয় দর্শক, ভয়াবহ দুর্ঘটনা!’ অথচ আহতরা পড়ে আছে রক্তে ভেজা রাস্তায়, প্রাথমিক চিকিৎসা না পেয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের বাঁশখালীর একটি দুর্ঘটনায় একজন গুরুতর আহত ব্যক্তি রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে ছিলেন। শরীর থেকে একটি পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চারপাশে লোকজনের ভিড়, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। কেউ ছবি তুলছে, কেউ ভিডিও করছে। ভাগ্যক্রমে, একটি গাড়ির কয়েকজন সচেতন যাত্রী দ্রুত নেমে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়, চিকিৎসা শুরু করে দেয়- তাই প্রাণে বেঁচে যান ওই ব্যক্তি। তবে, এ লোকের অবস্থা সংকটাপন্ন। এই উদাহরণ আমাদের সমাজের কঠিন বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়- আমরা এখন দর্শক, মানুষ নয়। একজন হাসপাতাল পরিচালক সম্প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন- ‘মানুষ এখন মরছে, আর আমরা ভিডিও করছি! বিবেক যেন মৃত। মানবিকতা যেন এখন ব্যাটারি ছাড়া একটা ডিভাইস।’
এ গুলোকে বলা চলে সোশ্যাল ডিজিস, যা ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি। বিশ্বজুড়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া ডোপামিন ডিজঅর্ডার’ বা ‘সোশ্যাল ডিজিস’ এখন বাস্তব মানসিক সমস্যা। অর্থাৎ, মানুষ এখন এমন এক মানসিক আসক্তিতে ভুগছে যেখানে বাস্তব ঘটনা নয়, বরং ডিজিটাল প্রতিক্রিয়া (লাইক, কমেন্ট, শেয়ার, ভিউ) তার আচরণ নির্ধারণ করছে। এই প্রবণতা আমাদের সমাজে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। দুর্ঘটনা, আগুন, বন্যা, আত্মহত্যা- সব জায়গায় আমরা ‘সাক্ষী’ নই, হয়ে গেছি ‘দর্শক’। একেকটা জীবন নিভে যাচ্ছে, আর আমরা ক্যামেরা চালিয়ে যাচ্ছি।
প্রযুক্তি আমাদের দিয়েছে শক্তি, যোগাযোগের সহজতা এবং তথ্যের প্রাচুর্য। কিন্তু সেই শক্তিই যদি মানবতার বিপরীতে কাজ করে, তাহলে তা অভিশাপে পরিণত হয়।
অগ্নিকাণ্ড বা দুর্ঘটনার সময় প্রথম করণীয় হলো মানুষ বাঁচানো, ছবি তোলা নয়। আহতকে নিরাপদ স্থানে সরানো, জরুরি নম্বরে কল দেওয়া (৯৯৯), প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা- এগুলোই একজন সচেতন নাগরিকের কর্তব্য।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে গড়ে ২২ হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। কিন্তু এর অর্ধেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় জনগণের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ আগুন নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। অর্থাৎ, সঠিক সময়ে মানবিক উদ্যোগ জীবন ও সম্পদ দুটোই বাঁচাতে পারে। আমাদের করণীয় হোক: দুর্ঘটনা বা অগ্নিকাণ্ড ঘটলে মোবাইল নয়- সাহায্যের হাত তুলি। আহতদের হাসপাতালে পৌঁছাতে এগিয়ে আসি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করুন সচেতনতার জন্য, প্রদর্শনের জন্য নয়। শিশু ও তরুণ প্রজন্মকে শেখান মানবিক মূল্যবোধ ‘ভিউ নয়, মূল্যবোধই বড়।’
আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যেখানে মানুষ আর কাঁদে না, শুধু রেকর্ড করে। আগুন নিভানোর বদলে আমরা শিখছি ভিডিও এডিট করতে, মানুষের কান্না এখন ট্রেন্ডিং সাউন্ডে রূপ নিচ্ছে। কিন্তু সময় এসেছে থামার, ভাবার। চলুন, আমরা আবার ফিরি সেই সময়ের মতো- যেখানে মানুষ আগুন নেভাতো হাতে, আর বাঁচাতো জীবন হৃদয়ের তাগিদে। ‘ভিউ নয়, ভাইরাল নয়, মানবিকতার জন্যই মানুষ হই।’
লেখক: শিব্বির আহমেদ রানা
গণমাধ্যমকর্মী ও কলাম লেখক
ই-মেইল: shibbirahmedctg1990@gmail.com