খুব বেশী দূরের কথা নয়। আজ থেকে দেড়-দুই যুগ আগের কথা। অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্য্যের সাথে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবেশে বিদায় অনুষ্ঠান হতো। সে সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানে গুণীজনদের দাওয়াত করা হতো, যা শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক উপকারের ছিল। বিদায় অনুষ্ঠানগুলোতে অন্তত শিক্ষাবান্ধব লোকজনদের গুরুত্ব দিতো বিদ্যালয় কতৃপক্ষ। সে সময়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, শিক্ষা অফিসার ও এলাকার প্রবীণ শিক্ষকদের অতিথি করা হতো। শিক্ষার্থীদের উদ্দ্যেশ্যে এদের অনেকেই অতীব গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শমূলক দিকনিদেশনাসূচক কতাবার্তা বলত। শিক্ষার্থীদের উদ্যেশ্যে মানবিক অনুপ্রেরণামূলক উপদেশ ও উৎসাহ ব্যঞ্জক কথা বলত মঞ্চে থাকা গুণীজনেরা। আর শিক্ষার্থীরা তন্ময় হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শ্রবণ করত গুণীদের উপদেশ ও শ্রুতিধর বানী। কালের পরিক্রমায় এখন স্বীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খোদ্ শিক্ষকেরাই মঞ্চে ঠাঁই পায় না। মঞ্চে জায়গা করে নেয় যারা শিক্ষার সাথে যায় না।
সে সময়ে বিদায় অনুষ্ঠানের ডাইসে (মঞ্চে) যারা বসত তারা সবাই গুণীজন ছিল। যাদের দেখলে শ্রদ্ধার মস্তকাবনত হত। প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও সফল গুণিজনদের মঞ্চস্থ করা হত সেকালোর অনুষ্ঠানগুলোতে। সে সময় এলাকার ছিঁচকে চোর, মৌসুমী ফল আম-কাঁঠাল-ডাব চোর, হাঁস-মুরগী চোর, খেতাবধারী বাটপার, আপাদমস্তক বেয়াদবগুলো মঞ্চে বসা তো দূরের কথা অনুষ্ঠানের নির্দিষ্ট এলাকায়ও প্রবেশ করার সুযোগ ছিলো না। আজকাল সেটা অনেকটা বদলে গেছে। যারা ছাত্র হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারেনি, স্কুল-মাদরাসার ক্যাম্পাসে যাদের কোনো পদচারণাই ছিলনা তারাও আজ বিদায় অনুষ্ঠানের মঞ্চে জবরদস্তি অতিথি! যাদের জীবনে ব্যর্থতা ছাড়া কিছুই নেই তারা বিদায়ি শিক্ষার্থীদের উদ্যেশ্যে কি এমন নছিহত রাখবে, কি এমন প্রেরণা-অনুপ্রেরণার কথা বলবে, কি উপদেশবাণী প্রসব করবে? অথচ তারা সুযোগ পেলে শিক্ষাগুরুর ঘাড়মটকানোর কথাও বলবে। শিক্ষকের আসনে গার্দারের মতো চেপে বসবে। তাদের পেছনে কিংবা সমাবেশের বেঞ্চেও জায়গা হয় না শিক্ষকের।
সেকালের বিদায় অনুষ্ঠানে বিদায়ি শিক্ষার্থীরা বিদায়ের দিন এতোটা নিরীহ, এতোটা বিনয়ী, জড়োসড়ো ভদ্র হয়ে বসে থাকতো। শান্ত জলের কুপে যেন বড় মাছের তলানীতে অস্থান। যা সে সময়ের শিক্ষার্থীরা ছাড়া এখনকার শিক্ষার্থীরা অনুধাবন করতে পারবে না। মাধ্যমিক স্তরে শুধুমাত্র পাঁচ বছর একসাথে পড়ালেখা করা, সবার সাথে পরিবারের সদস্যদের মতো আবদ্ধ থাকার স্মৃতিগুলো বিদায় মুহূর্তে আজব এক ম্লানময় পরিবেশে রুপ নিত। পাঁচ বছরে যাঁদের সান্নিধ্যে বড় হয়েছে (শিক্ষাগুরু) তাঁদের কাছে গিয়ে নতশিরে বিনয়ের সাথে কদমবুচি করে দোয়া নিতো সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সে সময়ের মুহুর্তগুলো তখন ছিল স্বর্গীয়। কি সম্মোহনী, কি আবেগ, কি স্বর্গীয় এক অনন্য পরিবেশ। এখন তার ছিঁটেফোটাও নেই।
এখন বিদায়ের অনুষ্ঠানে সেকেলের এনালগ পরিবেশ নেই। পাঁচটি বছর একসাথে থাকা, ভালো-মন্দের সাথে বেড়ে উঠা সহপাঠিরা অতীতের কোনো ভুল বুঝাবুঝির জন্য ক্ষমা চেয়ে নিত। শিক্ষাগুরুর সাথে অতিবিনয়ে আলাপ করে দোয়া চেয়ে নিতো শিক্ষার্থীরা। যাতে চলার পথ সুন্দর ও সুগম হয়। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কী এক কান্নার পরিবেশ। শিক্ষার্থী আর শিক্ষক উভয়ের চোখে নোনাজল। বিদায় মানে এখন ‘Rag day’ নামের অধুনিকতার স্পর্শ! ধ্বস্তাধস্তি, রং মাখামাখির কী এক রম্যরসাত্মক রঙ্গমেলা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব। মোবাইল ফোনে দাঁত ভিঞ্চিয়ে, কাঁধে কাঁধ রেখে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সেলফিবাজি দেখতে হয় এখন!
সবখানে পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়, যেমনটি আজকাল শিক্ষাপ্রতিষ্টানের জগাঁখিচুড়ি পরিবেশ! সে সময়ে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের দেখলে বিনয়াবনত হয়ে দূর থেকে কোন রকম ছাড়! এখন সে পরিবেশটা গড়িয়ে হাই, হ্যালো আর সেলফিতে দুরস্ত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিকতার এতোটা অধঃপতন হয়েছে যার কালের স্বাক্ষী সেকালের আর এ-কালের সাঁকোতে পরিমেয়।
এখন বিদায় অনুষ্ঠানে শেখ সাদীর কথা, শিক্ষকপ্রীতি হযরত ইমাম আবু হানিফার কথা, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা, শত সহস্র অমর গুণীজনের কথা উঠে আসেনা। এখন কোন রকম মাইক্রোফোন হাতে পেলেই জ্বালাময়ী কিছু স্লোগান, কিছু ধান ভাঙতে শীবেরগীত আর অপাত্রে ঘি ঢালার মতো অনধিকার চর্চা ছাড়া কিছুই নেই!
কলাম লেখক- গণমাধ্যমকর্মী
শিব্বির আহমদ রানা
ই-মেইল: shibbirahmed90@gmail.com