একটি জনপদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয় মেলে তার ইতিহাসচিহ্ন, অবকাঠামো ও মূল্যবোধে। গুণীজনদের স্মৃতিকে ধারণ করে যে যাত্রাপথ সমাজে গড়ে ওঠে, সেসব পথে তাঁদের নামে সড়ক নামকরণও একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। এটি শুধু স্মৃতির সংরক্ষণ নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নৈতিক শিক্ষা ও অনুপ্রেরণার উৎস।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার শীলকূপ ইউনিয়নের টাইম বাজার থেকে সওজ নির্মিত গন্ডামারা ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়দের কাছে ‘মরহুম আবুল হোসেন চৌধুরী সড়ক’ নামে পরিচিত। স্থানীয় পর্যায়ে প্রস্তাবিত এই নামকরণ শুধু আবেগ নয়, একটি বাস্তব ইতিহাস ও অবদানের স্বীকৃতি।
এই সড়কের উদ্বোধন করেছিলেন সাবেক বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী মরহুম আলহাজ্ব জাফরুল ইসলাম চৌধুরী। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সভাপতিত্বে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তৎকালীন ডিন ও দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মনছুর উদ্দিন আহমদ। এতসব ঐতিহাসিক মুহূর্তের পরেও দুঃখজনকভাবে আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক অশুভ চক্রান্তে ‘আবুল হোসেন চৌধুরী সড়ক’-এর নামফলক একপর্যায়ে ভেঙে ফেলা হয়।
যাঁর নামে এই সড়ক, সেই মরহুম আবুল হোসেন চৌধুরী ছিলেন এক অসাধারণ শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ও সমাজহিতৈষী। তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাঁশখালী ইউনাইটেড উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমান-বাঁশখালী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়), মনকিচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ডাকঘর। শিক্ষা অফিসার হিসেবে দীর্ঘ কর্মজীবন শেষে তিনি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাইতুশ শরফ আদর্শ মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত ও বাইতুশ শরফ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে যোগ দেন এবং তিনি এই প্রতিষ্ঠানে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। তিনি বাঁশখালী পৌরসভাস্থ দক্ষিণ জলদী রংগিয়াঘোনা মনছুরিয়া ফাযিল মাদরাসা’র পরিচালনা বোর্ডের (গভর্ণিং বোর্ড) সভাপতি ছিলেন। এলাকার জনকল্যাণে তাঁর দানশীলতা, অবদান ও স্মরণীয় ভূমিকার জন্য তাঁকে আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন সবাই। ১৯৯৬ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব, দানশীলতা ও জনকল্যাণমূলক অবদান আজও মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছে। তাঁর স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে বাঁশখালীর শীলকূপ ইউনিয়নের প্রধান সড়কটিকে আবুল হোসেন চৌধুরী সড়ক নামকরণ করা হয়েছে। এই সড়কের নাম তাঁর নামে নামকরণ করার দাবিটি তাই কেবল আবেগ নয়, একটি যৌক্তিক ঐতিহাসিক স্বীকৃতি।
এই সড়কটির নামকরণ সংক্রান্ত একটি সরকারি প্রমাণপত্রও রয়েছে, যা দাবিকে আরও দৃঢ় ভিত্তি দেয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম-এর একটি পত্রে (স্মারক নম্বর: এলজিইডি/পিডি (অগ্রাঃ)/এ-১০/২০০১ (অংশ-৪)/৭৯৮০; তারিখ: ২১/০৩/২০০২) উল্লেখ করা হয়েছে যে, টাইম বাজার থেকে গন্ডামারা ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কটি অগ্রাধিকারভুক্ত প্রকল্পের আওতায় মরহুম আবুল হোসেন চৌধুরীর নামে প্রস্তাবিত হয়েছে।
সুতরাং এখন সময় এসেছে এই সড়কের নামকরণ সরকারিভাবে চূড়ান্ত করে যথাযথ স্থানে পুনরায় নামফলক স্থাপন করার। এটি হবে শুধু একটি গুণীজনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নয়, বরং আগামী প্রজন্মের নিকট ইতিহাস, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের স্থায়ী দলিল। প্রশাসনের প্রতি জোরালো আহ্বান, দ্রুত ‘মরহুম আবুল হোসেন চৌধুরী সড়ক’ নামকরণ অনুমোদনপত্র জারি করে যথাযথ স্থানে স্থায়ী নামফলক স্থাপন করুন।
দলিল সূত্র:
[স্মারক নম্বর: এলজিইডি/পিডি (অগ্রাঃ)/এ-১০/২০০১ (অংশ-৪)/৭৯৮০। তারিখ: ২১/০৩/২০০২, উপজেলা: বাঁশখালী, ইউনিয়ন: শীলকূপ, সড়কের দৈর্ঘ্য: প্রায় ৬ কিলোমিটার। প্রেরক: মোহাম্মদ লোকমান হাকিম, প্রকল্প পরিচালক।]
লেখক-
শিব্বির আহমদ রানা
(গণমাধ্যমকর্মী)
বাঁশখালী, চট্টগ্রাম।
ই-মেইল: shibbirahmed90@gmail.com