শেখেরখীল, চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা। দিনটি ছিল ৪ আগস্ট। এ তারিখ কেবল একটি দিন নয়, বরং যন্ত্রণা, প্রতিবাদ ও ত্যাগের প্রতীক। বাঁশখালীর শেখেরখীল আজও সাক্ষী হয়ে আছে কীভাবে ন্যায়ের দাবিতে রাস্তায় নামা তরুণদের উপর নেমে এসেছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কালো ছায়া।
রাত জেগে আন্দোলনের প্রস্তুতি: ৪ আগস্ট’র আগের রাত। রাহি, জালাল, ইমরান, মোবারক, জাবেদ, আব্দুন্নুর, হিজবুল্লাহসহ ১৫-২০ জন তরুণ গোপনে আন্দোলনের পরিকল্পনা করেন। তারা তৈরি করেছিলেন একটি অনলাইন গ্রুপ, যেখানে সারারাত চলে আলোচনা।
স্লোগান ছিল জোরালো ও স্পষ্ট—
“তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা!”
“তোর কোটা তুই নে, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দে!”
তাদের স্বপ্ন ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। দাবি ছিল যৌক্তিক—কোটা সংস্কার। কিন্তু তারা জানত না, সামনে অপেক্ষা করছে এক বিভীষিকাময় রাত।
হামলার কালো অধ্যায়: ৪ আগস্ট সকালে যখন তরুণরা মাঠে নামে, তখন শুরু হয় সহিংসতার রক্তাক্ত নাটক। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যে, ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও পুলিশের যৌথ বাহিনী আন্দোলনকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে নিরীহ ছাত্রজনতার উপর। লাঠিচার্জ, কিল-ঘুষি-লাথি—সব একসাথে।
“আমরা রাজাকার নই। আমরা এই দেশের সন্তান, ন্যায়ের জন্য লড়ছিলাম। অথচ আমাদের সাথে আচরণ করা হয়েছে শত্রুর মতো।” রক্তাক্ত দেহ, আজও বয়ে বেড়ানো ক্ষতচিহ্ন হৃদয়ে নাড়া দেয়। হামলায় অন্তত ৫০-৬০ জন গুরুতর আহত হন। অনেকের চোখ, কোমর ও পায়ে এমন আঘাত লাগে যা আজও সারেনি। কেউ কেউ সেদিনের ঘটনার কথা মনে পড়লে আতঙ্কে কেঁপে ওঠেন। সে আন্দোলনে আহত অনেকেই এখনো সেই দিনের ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন। হাঁটতে গেলে কোমরের ব্যথা মনে করিয়ে দেয়—আমরা ন্যায়ের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলাম, আর তার জবাব পেয়েছিলাম লাঠি-গুলিতে।”
কোটা সংস্কারের বাইরে, এটি ছিল গণজাগরণ: স্থানীয়রা মনে করেন, শেখেরখীলের এ আন্দোলন শুধু কোটা সংস্কারের জন্য ছিল না—এটি ছিল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনগণের গণজাগরণের সূচনা। এই ঘটনার পর অনেকেই উপলব্ধি করেন, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ জনগণের হাতে নেই, বরং একটি শক্তিশালী ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতে বন্দি।
ইতিহাসের কাঠগড়ায় একদিন জবাবদিহি: আন্দোলনকারীরা বিশ্বাস করেন, শেখেরখীলের এই রক্তাক্ত স্মৃতি বৃথা যাবে না। একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে সেই সব শাসকদের, যারা প্রতিবাদী কণ্ঠরোধে গুলি চালিয়েছে।
প্রেক্ষাপট: বাঁশখালী শেখেরখীলের লড়াই। শেখেরখীলের এই ঘটনা বাংলাদেশের আন্দোলন ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে। কারণ এটি দেখিয়ে দিয়েছে—যুব সমাজ যখন ন্যায়ের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন ক্ষমতাসীনরা ভয় পায়। এ ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, স্বৈরাচার জুলুম যতই চালাক, জনতার রক্ত একদিন নতুন স্বাধীনতার সূর্যোদয় ডেকে আনে।
আমাদের ঘোষণা: “জয় হোক গণআন্দোলনের, জয় হোক ন্যায়ের। জয় হোক গণঅভ্যুত্থানের। জয় হোক জনতার বিপ্লবের। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।”
রাজপথ থেকে-
ইউনুছ তামিম
(জুলাই যোদ্ধা, বাঁশখালী)