ডিজিটাল যুগে ফেসবুক আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। তথ্য আদান-প্রদান, যোগাযোগ, বিনোদন থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু এ মাধ্যমের ইতিবাচক ব্যবহার যেমন সমাজকে এগিয়ে নিতে পারে, তেমনি এর অপব্যবহার ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনছে। বিশেষ করে “হুটহাট লাইভ সংস্কৃতি” এবং ফেসবুকে অযাচিত কনটেন্ট প্রকাশের প্রবণতা এখন এক ধরনের সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে।
ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক অনেক অনুষ্ঠান বা বৈঠকে এমন কিছু বিষয় থাকে, যা স্বভাবতই গোপনীয় এবং অপ্রচারযোগ্য। কিন্তু দেখা যায়, কিছু মানুষ অতি উৎসাহী হয়ে সেই গোপনীয় বিষয়গুলোও প্রকাশ্যে নিয়ে আসছেন। কখনো লাইভে গিয়ে, কখনো ছবি বা ভিডিও পোস্ট করে। একদিকে তারা হয়তো ‘ট্রেন্ড’ ধরতে চান, অন্যদিকে অনেকেই ফেসবুক মনিটাইজেশনের মোহে পড়ে যাচ্ছেন। ফলাফল- গোপনীয়তার দেয়াল ভেঙে সামাজিক সম্পর্কের ভাঙন, প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতি নষ্ট হওয়া এবং কখনো কখনো সহিংসতা পর্যন্ত গড়ানো।
এতে সামাজিকভাবে কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেমন- পারিবারিক অশান্তি: দাম্পত্য কলহ, উত্তরাধিকার বিরোধ বা পারিবারিক ঝগড়া ফেসবুকে প্রকাশ হয়ে গেলে তা আরো বড় আকার ধারণ করে। আত্মীয়তার বন্ধন দুর্বল হয়, সম্পর্ক ভাঙনের দিকে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষতি: অফিস, সংগঠন বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ আলোচনা বা সিদ্ধান্ত বাইরে ছড়িয়ে পড়লে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়। এতে প্রতিষ্ঠান তার গ্রহণযোগ্যতা হারায়। রাজনৈতিক অস্থিরতা: রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক বৈঠকের গোপন তথ্য ফেসবুকে এলে তা প্রতিপক্ষের হাতে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর জেরে মাঠে সংঘর্ষ, সহিংসতা, এমনকি প্রাণহানিও ঘটে। আইনি জটিলতা: কারো অনুমতি ছাড়া ভিডিও বা ছবি প্রকাশ করা সরাসরি ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ। এর কারণে মামলাজট, জরিমানা এমনকি কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। মানসিক ক্ষতি: অপমানজনক বা সংবেদনশীল বিষয় প্রকাশ পেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি গভীর মানসিক আঘাত পান, যা অনেক সময় আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্তেও ঠেলে দিতে পারে।
সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, ছোটখাটো দুর্ঘটনা, পারিবারিক বিবাদ এমনকি স্থানীয় রাজনৈতিক বৈঠকও ফেসবুকে লাইভ হচ্ছে। এতে উত্তেজনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং মুহূর্তেই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যাচ্ছে। কিছু সংবাদমাধ্যমও যাচাই না করেই এসব লাইভ বা ভিডিওকে খবর বানিয়ে দিচ্ছে, ফলে বিভ্রান্তি আরও বাড়ছে।
ফেসবুকসহ সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে পরিবার ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে। শিশু-কিশোরদের এ বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। পাশাপাশি সরকারকেও প্রয়োজনীয় নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হবে যেন গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্ব সবার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। ফেসবুক কেবল একটি যোগাযোগ মাধ্যম- এটি জীবনের বিকল্প নয়। নিজের সুনাম, পরিবারের সম্মান এবং সমাজের স্থিতি রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার।
যেমন সঠিক ওষুধ জীবন রক্ষা করে আর অতিরিক্ত ওষুধ জীবনহানির কারণ হয়, তেমনি ফেসবুকও নিয়ন্ত্রিত ও দায়িত্বশীল ব্যবহারে আমাদের জীবনকে সহজ করবে, কিন্তু বেপরোয়া ও অযাচিত ব্যবহার আমাদের সমাজকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেবে। এখনই সময় “হুটহাট লাইভ সংস্কৃতি” থেকে বের হয়ে গোপনীয়তার মর্যাদা রক্ষা করার। নইলে আমরা নিজেরাই তৈরি করব এমন এক পরিস্থিতি, যেখানে ফেসবুক হবে সহিংসতার প্রধান উস্কানিদাতা।
লেখক-
✍ শিব্বির আহমেদ রানা
গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট
ই-মেইল: shibbirahmedctg1990@gmail.com