প্রায় ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ শেষে মুক্ত বাংলাদেশ যখন নতুন পথচলায়, তখনও গ্রামীণ জনপদ ছিলো শিক্ষা ও উন্নয়ন থেকে বহু দূরে। এমন অবহেলিত সময়ে যাঁরা আলোকবর্তিকা হয়ে মানুষের মধ্যে শিক্ষা-সচেতনতা ও অধিকারবোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন, তাঁদের মধ্যে শেখেরখীলের অন্যতম গর্বিত সন্তান ছিলেন মাস্টার মোহাম্মদ ইদ্রিস।
১৯৩০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাঁশখালীর উত্তর শেখেরখিলে জন্ম নেন তিনি। ১৯৪৭ সালে জলদি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, পরে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তৎকালীন বাঁশখালীতে উচ্চশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা, আর তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাস্টার ইদ্রিস।
কর্মজীবনের শুরুতেই ব্যক্তিগত সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে তিনি গ্রামীণ জনসাধারণের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৫৮ সালে জনতার ভালোবাসায় মেম্বার নির্বাচিত হন এবং একই বছরের ১৪ জুলাই শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন সরল উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে নাপোড়া শেখেরখীল উচ্চ বিদ্যালয় ও সর্বশেষ চাম্বল উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৯৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন তিনি।
শিক্ষা বিস্তারে অগ্রদূত: মাস্টার ইদ্রিস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন—শিক্ষা ছাড়া মুক্তি সম্ভব নয়। তাই সারাজীবন শিক্ষা বিস্তারে নিজেকে নিবেদিত রাখেন। শেখেরখীল ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি।
প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে উন্নয়নের রূপকার: স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে তিনি শেখেরখীল ইউনিয়নের প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ইউনিয়নের ব্রিজ, রাস্তা, খাল খনন, নলকূপ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ প্রতিষ্ঠাসহ সমাজ সংস্কারমূলক কাজে রেখেছেন অমর স্বাক্ষর। তাঁর দূরদর্শিতার ফলেই খনন করা হয় শেখেরখীলের প্রাণখ্যাত “বাংলা খাল”—যা এখনো অঞ্চলের কৃষি ও জীবনের প্রধান রক্ষাকবচ। খনন শেষে বরাদ্দ অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত দিয়ে তিনি সততার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
সততা, ন্যায়বিচার ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতীক: সরকারি বরাদ্দকৃত নলকূপ কিংবা রাস্তা নিজের বাড়ির জন্য ব্যবহার না করে সাধারণ মানুষের জন্য প্রদান করেন। বিচারকার্যে ধর্মীয় নীতিবোধ ও প্রখ্যাত আলেমদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন তিনি। “ন্যায়বিচারক কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ায় থাকবেন”—এই নীতিবাক্যে ছিলেন প্রভাবিত।
সাহসী ও দূরদর্শী কণ্ঠস্বর: ১৯৬০ সালের ভয়াবহ বন্যা ও কলেরা মহামারীতে তিনি সরাসরি তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নরকে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেন। এতে ক্ষমতাসীন মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং জেলা প্রশাসককে শেখেরখীল পরিদর্শনে আসতে বাধ্য করা হয়।
জীবন্ত কিংবদন্তি: তিনি কেবল শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন এক চলমান বিশ্ববিদ্যালয়। স্থানীয়রা বিশ্বাস করতেন—শেখেরখীলের কোনো শিক্ষার্থীর বিদ্যা পূর্ণ হবে না, যদি অন্তত একবার মাস্টার ইদ্রিসের কাছ থেকে শিক্ষা না নেয়। বাঁশখালীর কিংবদন্তি শিক্ষক নওয়াব আলী স্যার ও মালেক স্যারও তাঁর ছাত্র ছিলেন এবং আজীবন তা নিয়ে গর্ব করেছেন।
শেষযাত্রা: ধর্মভীরু, প্রচারবিমুখ, জনহিতৈষী এই মহান ব্যক্তিত্ব ২০১৮ সালের ২৩ মে ইন্তেকাল করেন। পেছনে রেখে যান অসংখ্য স্মৃতি, অমলিন অবদান আর একটি পূর্ণ প্রজন্মকে আলোকিত করার উত্তরাধিকার।
✍️ ইফতেখারুল ইসলাম
প্রকাশক ও সম্পাদক : শিব্বির আহমদ রানা, ফোন নম্বর: ০১৮১৩৯২২৪২৮, 𝐄-𝐦𝐚𝐢𝐥: 𝐛𝐚𝐧𝐬𝐡𝐤𝐡𝐚𝐥𝐢𝐬𝐚𝐧𝐠𝐥𝐚𝐩@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦
অস্থায়ী ঠিকানা: স্মরণিকা প্রিন্টিং প্রেস। উপজেলা সদর, জলদী, বাঁশখালী, পৌরসভা, চট্টগ্রাম
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত