চিকিৎসা সেবা মানবতার অন্যতম মহৎ পেশা। প্রাচীনকাল থেকে চিকিৎসককে সমাজে জ্ঞানী, দয়ালু ও মানবিক প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। রোগীরা ডাক্তারকে মানেন অভিভাবকের মতো, যার হাতে তাদের জীবন-মৃত্যুর ভার। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশে চিকিৎসা খাতের একাংশে সেই মহৎ পেশার মর্যাদা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। ডাক্তার–রোগীর সম্পর্ক অনেক জায়গায় পরিণত হয়েছে আস্থা নয়, বরং বাণিজ্যের খদ্দেরি সম্পর্কে।
আজকাল অনেক ডাক্তার এমন সব ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন, যা কেবল তার চেম্বারের পাশের নির্দিষ্ট ফার্মেসীতেই পাওয়া যায়। দেশের অন্য কোনো দোকানে পাওয়া যায় না। বিকল্প কোনো ব্র্যান্ডও তারা উল্লেখ করেন না। প্রেসক্রিপশন ফাঁদে রোগী বাধ্য হয় ওই দোকান থেকেই ওষুধ কিনতে। এভাবে চিকিৎসকের কলম আর নিরপেক্ষ থাকে না—বরং ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির শিকলে বাঁধা পড়ে যায়।
রোগীর ভিড়ে ভরা চেম্বারে প্রায়শই দেখা যায়-কোম্পানির মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা সারি বেঁধে বসে আছেন। তারা ডাক্তারকে ঘন্টার পর ঘন্টা ‘ব্রিফিং’ দেন—“স্যার, আমাদের ওষুধ লিখুন, রোগীর জন্য অত্যন্ত কার্যকর।” এই অনুনয়-বিনয়ের মাঝেই রোগী অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়। এখানেই শেষ নয়—রোগীর প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে কোম্পানির হেড অফিসে পাঠানো হয়, যেন প্রমাণ থাকে, ডাক্তার তাদের ওষুধ লিখছেন। অথচ প্রেসক্রিপশন রোগীর একান্ত গোপন নথি—যা এভাবে প্রকাশ করা রোগীর অধিকার হরণের সামিল।
চেম্বার শেষে ডাক্তারের টেবিলে জমা হয় নানান উপঢৌকন- গৃহস্থলির জিনিসপত্র থেকে শুরু করে দামী ইলেকট্রনিক্স। এমনকি কারও কারও চেম্বারের এসি পর্যন্ত কোম্পানির উপহার! এতে চিকিৎসকের নৈতিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়। ফলে প্রেসক্রিপশন হয়ে ওঠে বাজারের প্রতিযোগিতার হাতিয়ার।
শুধু ওষুধই নয়, পরীক্ষার ক্ষেত্রেও একই চিত্র। প্রেসক্রিপশনে থাকে লম্বা তালিকা- এই টেস্ট, সেই টেস্ট। রোগী যদি ভিন্ন ল্যাবে পরীক্ষা করাতে যায়, ডাক্তার অখুশি হন। আবার চেম্বারের ভেতরেই যদি ল্যাব থাকে, তবে রোগীর পক্ষে অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগই থাকে না। ফলে রোগীর পকেট ফাঁকা হয়, অথচ রোগীর সেবার জায়গায় তৈরি হয় এক ধরনের ব্যবসায়িক একচেটিয়া বাজার।
গ্রামের সাধারণ মানুষের ভরসা সরকারি হাসপাতাল। অথচ সেখানে অনেক চিকিৎসক নির্ধারিত সময়ে সেবা দিতে অনিহা প্রকাশ করেন। অনেক সময় রোগী পেলেও তেমন মনোযোগ দিয়ে কাউন্সেলিং করেন না। কিন্তু একই চিকিৎসক ব্যক্তিগত চেম্বারে গেলে আচরণ সম্পূর্ণ বদলে যায়। রোগীকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়, সময় দিয়ে বোঝানো হয়। এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—সরকারি দায়িত্ব নয়, বরং ব্যক্তিগত বাণিজ্যিক স্বার্থই যেন চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারপর আরেকটি নোংরা দিক হলো দালাল সংস্কৃতি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, হাসপাতালের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা দালালরা রোগীকে নির্দিষ্ট ডাক্তার বা চেম্বারে পাঠায় কমিশনের বিনিময়ে। চিকিৎসার বিজ্ঞাপন হয় রোগীর কান ধরে টানাটানির মাধ্যমে। এতে চিকিৎসা সেবার মান কমে যায়, আর মানুষ চিকিৎসককে সম্মান নয়, অবিশ্বাসের চোখে দেখতে শুরু করে।
করণীয়: এই ভয়াবহ বাস্তবতায় প্রশ্ন জাগে- চিকিৎসা কি তবে নিছক ব্যবসা? রোগী কি কেবল একেকজন খদ্দের?
চিকিৎসা খাতকে পরিশুদ্ধ করতে হলে এখনই কিছু পদক্ষেপ জরুরি- ক) ওষুধ নীতিমালা কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। প্রেসক্রিপশনে ব্র্যান্ড নয়, জেনেরিক নাম লেখার প্রচলন বাড়াতে হবে। বিকল্প ব্র্যান্ড উল্লেখ বাধ্যতামূলক করতে হবে। খ) কোম্পানি-চিকিৎসক যোগসাজশ নিয়ন্ত্রণ রুখতে হবে। উপঢৌকন গ্রহণ ও প্রভাবিত প্রেসক্রিপশনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। গ) রোগীর গোপনীয়তা রক্ষায় প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলা বা তথ্য ফাঁস করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।ঘ) সরকারি হাসপাতালে জবাবদিহিতা আনতে হবে। সরকারি চাকরির সময় সরকারি দায়িত্বেই চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। চেম্বার প্রলুব্ধকরণকে দমন করতে হবে। ঙ) দালাল সংস্কৃতি নির্মূলে হাসপাতাল ও চেম্বার এলাকায় দালালদের প্রবেশ আইনত দণ্ডনীয় করতে হবে।
পরিশেষে, চিকিৎসা পেশা সেবার জন্য, ব্যবসার জন্য নয়। রোগী ডাক্তারকে আস্থার স্থান হিসেবে দেখতে চায়, খদ্দের হিসেবে নয়। যদি এই বাণিজ্যিকীকরণের লাগাম এখনই টেনে ধরা না হয়, তবে মানুষ চিকিৎসকদের কাছ থেকে আস্থা হারাবে-যা সমাজের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। চিকিৎসার মূল মন্ত্র হোক- মানবিক সেবা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা।
-লেখক
শিব্বির আহমদ রানা
সংবাদকর্মী ও কলামিস্ট
ই-মেইল:
প্রকাশক ও সম্পাদক : শিব্বির আহমদ রানা, ফোন নম্বর: ০১৮১৩৯২২৪২৮, 𝐄-𝐦𝐚𝐢𝐥: 𝐛𝐚𝐧𝐬𝐡𝐤𝐡𝐚𝐥𝐢𝐬𝐚𝐧𝐠𝐥𝐚𝐩@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦
অস্থায়ী ঠিকানা: স্মরণিকা প্রিন্টিং প্রেস। উপজেলা সদর, জলদী, বাঁশখালী, পৌরসভা, চট্টগ্রাম
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত