কোটাবিরোধী আন্দোলনে যখন সারাদেশ উত্তাল, আমি তখন গ্রামে থাকলেও মনটা পড়ে থাকত শহরে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রায় সব শহরে আন্দোলন দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। কিন্তু গ্রামে তখনও সেরকমভাবে আন্দোলনের ঢেউ ওঠেনি। দেশের জন্য নিরপরাধ সাধারণ মানুষ ও ছাত্রজনতার জীবন বলিদান সহ্য করতে না পেরে আমি বেশ কয়েকবার শহরে ছুটে যাই—দুই নাম্বার গেইট, চেরাগীপাহাড়, মুরাদপুর—যেখানে যেখানেই সুযোগ পেয়েছি। কখনো পরিবার জানত, কখনো না বলেই চলে গিয়েছি। মনে তখন হতাশা, ক্ষোভ ও দেশের জন্য অদম্য চিন্তা। আওয়ামী সরকারের দোসর পুলিশ আর দলীয় বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালাত—এমনকি কচি শিশুর ওপরও।
পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ হলে অনেক শিক্ষার্থী গ্রামে ফিরে আসে, আর আন্দোলনের আগুন গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ৪ আগস্ট আমরা বাঁশখালীর ছাত্র-জনতা মিলে দুর্বার আন্দোলনের পরিকল্পনা করি। আমি, মুমিন ভাইসহ কয়েকজন মিলে একটি গ্রুপ গঠন করি। আন্দোলনকে গতিশীল করতে আগের রাতে সারারাত চলতে থাকে আলোচনা।
সেদিন ভোর থেকেই খবর আসতে থাকে—বাঁশখালীর বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্ররা জড়ো হচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে আওয়ামী যুবলীগ-ছাত্রলীগ আর পুলিশেরও ছিল কড়া অবস্থান। মুক্তি আর ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা আমার চোখে ভাসছিল। বাড়ি থেকে হাসিমুখে বিদায় নিলাম। স্ত্রী বিদায়বেলায় বললেন— "হয় আবার দেখা হবে, না হলে দেখা হবে জান্নাতে।" এই কথা আমাকে আরও সাহসী করে তুলল।
হাজীপাড়া, বাংলাবাজার হয়ে ফাহিম কমিউনিটি সেন্টারের কাছে পৌঁছালাম। পথে অনেকের সঙ্গে দেখা—গন্ডামারার ইমু ভাই, শাহাদাত ভাই, ইলিয়াস ফারুক ভাইসহ আরও অনেকে মিছিলে যোগ দিলেন। ফাহিম কমিউনিটি সেন্টার থেকে কিছুটা সামনে গিয়ে মহিলা মাদরাসার কাছে পৌঁছাতেই স্লোগানে গর্জে উঠলাম। কিন্তু পরক্ষণেই যুবলীগ-ছাত্রলীগ আর পুলিশের গুলি বর্ষণ শুরু হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই আমি গুলিবিদ্ধ হই—চিড়া গুলি শরীর ভেদ করে। পড়ে যাই, সেন্স হারাই।
জ্ঞান ফিরলে নিজেকে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাই। তারা বললেন, দ্রুত এলাকা ছেড়ে গিয়ে গুলি বের করাতে হবে। স্থানীয় চিকিৎসকরা ভয় পেয়ে পুরো চিকিৎসা দিতে রাজি না হলেও প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেন। বাড়ি ফিরতেই পরিবারের সবাই আতঙ্কিত হয়ে যায়, ছোট্ট মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করে—
"পাপ্পা, তোমার শরীরে রক্ত কেন?"
স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গোপনে কয়েকটি গুলি বের করালাম। তবে কয়েকটি থেকে গেল। দুই দিন পরে গোপনে জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে বাকিগুলো বের করালাম। গুলি বের হওয়ার খবর পেয়ে মনটা আবার আন্দোলনের মাঠে ফিরতে চাইছিল। কিন্তু মেয়ের কাঁদতে কাঁদতে বলা: "পাপ্পা, তুমি আর যেও না, ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে"—আমাকে ভেঙে দেয়। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে স্বার্থপরের মতো বললাম—"না মা, আর যাবো না।"
এর মধ্যেই খবর এল—আওয়ামী যুবলীগ-ছাত্রলীগ হাসপাতালেও হামলা চালিয়েছে। বাঁশখালী জেনারেল হাসপাতাল ও ন্যাশনাল হাসপাতালে তাণ্ডব চালিয়ে এমনকি এক ডেলিভারি রোগীকেও টেনে বের করে মারধর করেছে। এ দৃশ্য একদিকে আন্দোলনের সোনালি দিনের স্মৃতি, অন্যদিকে বেদনা আর হারানোর ক্ষতচিহ্ন।
৪ আগস্ট আমার কাছে একদিকে স্মরণীয় বিপ্লবের দিন, অন্যদিকে জীবনের এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা হয়ে রইল।
লেখক-
ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক রাহাত
(জুলাই যোদ্ধা, বাঁশখালী)
প্রকাশক ও সম্পাদক : শিব্বির আহমদ রানা, ফোন নম্বর: ০১৮১৩৯২২৪২৮, 𝐄-𝐦𝐚𝐢𝐥: 𝐛𝐚𝐧𝐬𝐡𝐤𝐡𝐚𝐥𝐢𝐬𝐚𝐧𝐠𝐥𝐚𝐩@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦
অস্থায়ী ঠিকানা: স্মরণিকা প্রিন্টিং প্রেস। উপজেলা সদর, জলদী, বাঁশখালী, পৌরসভা, চট্টগ্রাম
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত