চট্টগ্রামে বৃষ্টি এখন আর প্রকৃতির ছন্দ নয়, এটি হয়ে উঠেছে এক প্রকার রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতীক। বৃষ্টি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই শহরের মানুষ যে ভয় নিয়ে দরজা বন্ধ করে, সে ভয় প্রকৃতির নয় এই ভয় ব্যবস্থার। এক ঘণ্টা টানা বৃষ্টি হলেই নগরীর রাস্তা পানিতে তলিয়ে যায়, পা ডুবে যায় হাঁটুতে, কিছু কিছু এলাকায় কোমরসমান পানি। এটুকু জেনে নেওয়ার পরও যদি কেউ বলে চট্টগ্রাম একটি ‘উন্নয়নশীল শহর’, তবে বুঝে নিতে হবে 'উন্নয়ন' শব্দটি এখন মানে হারিয়েছে।
এই শহরেই দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর, আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। অথচ বর্ষার প্রথম বৃষ্টি মানেই আগ্রাবাদ, বহদ্দারহাট, একে খান, চকবাজার, খুলশী, দামপাড়া, মুরাদপুর যে এলাকা বলবেন, সেখানেই জলজ ট্র্যাজেডি। সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (CDA), পানি উন্নয়ন বোর্ড তিন তিনটি সংস্থা থাকে, অথচ শহরের নালা থাকে না, খাল থাকে না, থাকে না বৃষ্টির পানির স্বাভাবিক নিষ্কাশনের পথ। চট্টগ্রামে বৃষ্টি মানে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া, অ্যাম্বুলেন্স আটকে যাওয়া, রিকশা উল্টে যাওয়া, অফিসে পৌঁছাতে দেড় ঘণ্টা লাগা, আর ঘরে ফিরে চুলার নিচে পানি জমে যাওয়া। এসব দৃশ্য এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে কেউ আর রাগও করে না, কেউ প্রতিবাদও করে না সবাই জানে, এই শহরে বৃষ্টিকে কেউ থামাতে পারবে না, এবং তার চেয়েও দুঃখের কথা, বৃষ্টির পরে জমে থাকা পানিকেও না।
একটা আধুনিক শহরে যখন মানুষ বোঝে বৃষ্টিতে রাস্তায় বের হওয়া মানে নিজেরই বিপদ ডেকে আনা, তখন সে শহরের উন্নয়ন আর শ্লোগানে থাকে না, থাকে শুধুই বিজ্ঞাপনে। মেগা প্রকল্পের ব্যানারে ঢাকা পড়ে যায় নাগরিকের পায়ের নিচের কাদা। কোটি কোটি টাকা খরচ করে খাল খননের যে উদ্যোগ, তা বাস্তবে দেখা যায় না। বরং খালের জায়গায় গড়ে ওঠে ভবন, ড্রেনের মুখে বাঁশের খাঁচা, আর পানি জমে থাকে দিনের পর দিন। এই শহর আমাদের শেখায় পরিকল্পনা যদি মানুষের জন্য না হয়, তবে সে পরিকল্পনা কেবল চুক্তিপত্রের পাতায় জমা থাকে। এই শহর আমাদের মনে করিয়ে দেয় নাগরিক যদি প্রতিটি মৌসুমি বৃষ্টিতে রাষ্ট্রের কাছে পরাজিত হয়, তবে সে নাগরিক আর নাগরিক থাকে না, হয়ে ওঠে কেবল কাদা ঘেরা একটা ভূগোলে বন্দি মানুষ।
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা এখন প্রকৌশলগত সমস্যা নয়, এটি রাজনৈতিক সদিচ্ছার সংকট। কে দখল করছে খাল, কে অনুমতি দিচ্ছে পাহাড় কেটে বাড়ি করতে, কে নজর রাখছে ড্রেনেজ লাইনের উপর এই প্রশ্নগুলোর জবাব নেই বলেই আজকের এই অবস্থা। মানুষ যখন ঘরে ঢোকার আগে প্যান্ট গুটিয়ে নেয়, তখন বুঝতে হবে, শহর ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব থেকে সরে এসেছে। আর নাগরিক, সে কেবল দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টির নিচে একাই।
আমরা উন্নয়নের গল্প শুনি, কিন্তু সেই গল্পে একবারও বলে না চট্টগ্রামে একজন গর্ভবতী নারী কীভাবে হাসপাতালে পৌঁছায় বৃষ্টির দিনে। বলে না একজন দিনমজুর কতটা ঠাণ্ডা পানিতে হেঁটে কাজে পৌঁছে তারপর আবার সেদিনের খাবার জোটাতে চেষ্টা করে। এই শহরে উন্নয়ন হলে, তার চিহ্ন মানুষ দেখে না পত্রিকার ছবিতে, মানুষ খোঁজে সেটা নিজের শুকনো পায়ের আঙুলে, নিজের বাসার মেঝেতে। যদি শহর তা দিতে না পারে, তবে উন্নয়ন একটি রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়।
চট্টগ্রামে বৃষ্টি মানেই আজ রাষ্ট্রের মুখোশ খুলে যাওয়া যেখানে রাজনীতি, পরিকল্পনা, অর্থনীতি সবকিছু মিলেমিশে দাঁড়িয়ে থাকে একটিমাত্র প্রশ্নে: এই শহরে নাগরিক মানেই কি কেবল দুর্ভোগে বাঁচা?
প্রকাশক ও সম্পাদক : শিব্বির আহমদ রানা, ফোন নম্বর: ০১৮১৩৯২২৪২৮, 𝐄-𝐦𝐚𝐢𝐥: 𝐛𝐚𝐧𝐬𝐡𝐤𝐡𝐚𝐥𝐢𝐬𝐚𝐧𝐠𝐥𝐚𝐩@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦
অস্থায়ী ঠিকানা: স্মরণিকা প্রিন্টিং প্রেস। উপজেলা সদর, জলদী, বাঁশখালী, পৌরসভা, চট্টগ্রাম
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত