বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। স্বাধীনতার অর্ধশতকের বেশি সময় পেরিয়ে এলেও আমরা এখনো প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তির খাতে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সাধন করতে পারিনি। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশীরা দ্রুতগতিতে এই খাতে এগিয়ে গেছে। প্রশ্ন ওঠে আমরা কেন পিছিয়ে? এর পেছনে সবচেয়ে বড় দুটি কারণ হলো দুর্নীতি এবং বাজেটের সীমাবদ্ধতা। তবে এসব শব্দের পেছনে লুকিয়ে আছে বৃহৎ এক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতা, যাকে পাশ কাটিয়ে টেকসই উন্নয়ন কল্পনাও করা যায় না।
প্রথমেই দুর্নীতির কথাই ধরা যাক। প্রযুক্তি বা প্রতিরক্ষা খাতে দুর্নীতির প্রভাব হয় দ্বিমাত্রিক একদিকে বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় হয় না, অন্যদিকে দক্ষ মানুষজন হতাশ হয়ে পড়েন এবং অনেকে বিদেশমুখী হন। কোনো প্রকল্পের বাজেট বরাদ্দ হলেও বাস্তবে তার অর্ধেক অর্থ চলে যায় নানা ধাপে ঘুষ, কমিশন বা প্রশাসনিক অপচয়ে। ফলে প্রকল্প অসম্পূর্ণ থাকে বা মানহীনভাবে বাস্তবায়িত হয়। এই চিত্র আমরা প্রায় সব সরকারি প্রযুক্তি প্রকল্পেই দেখি আইসিটি খাত থেকে শুরু করে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় পর্যন্ত।
দুর্নীতির আরেকটি ভয়াবহ রূপ হলো গবেষণা ও উদ্ভাবনে বাধা। উন্নত দেশগুলো যেখানে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বিপুল অর্থ ও স্বাধীনতা দেয়, সেখানে আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেই সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ সেখানে বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা বাস্তব গবেষণার জন্য ব্যবহৃত হয় না। এ থেকে বোঝা যায়, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা কোনো আর্থিক সংকটের ফল নয়, বরং এটি একটি প্রশাসনিক ও মানসিক সংকট যেখানে রাষ্ট্র নিজেই উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
অন্যদিকে বাজেটের সংকট একটি দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সমস্যা। বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের বড় একটি অংশ যায় বেতন, ভাতায় । প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষাকে বরাবরই কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। অথচ আজকের বিশ্বে প্রতিরক্ষা মানেই কেবল অস্ত্র বা সৈনিক নয়, বরং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাইবার নিরাপত্তা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ড্রোন প্রযুক্তি ও মহাকাশ গবেষণার মতো বিষয়। এসব খাতে বিনিয়োগ ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্র হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু বাজেট বরাদ্দের দোহাই দিয়ে আমরা এসবকে ‘বিলাসিতা’ বলে এড়িয়ে চলি, যার পরিণতি দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ হতে পারে।
এত সীমাবদ্ধ বাজেট থেকেও যদি সঠিক পরিকল্পনা ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থাপনা থাকত, তাহলে কিছু উন্নয়ন সম্ভব হতো। কিন্তু আমরা দেখি সীমিত বাজেটের বড় অংশও অপচয়ের কারণে নষ্ট হয়ে যায়। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনাকাটায় স্বচ্ছতা নেই, অনেক ক্ষেত্রে পুরনো ও কার্যকারিতা হারানো প্রযুক্তি আমদানি করা হয় উচ্চ মূল্যে। আবার সামরিক বাহিনীর অনেক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা প্রকল্প কাগজে থাকে, বাস্তবে তার তেমন কার্যকারিতা থাকে না।
প্রযুক্তি খাতেও একই চিত্র। শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা মাঠপর্যায়ে কার্যকর নয়। স্কুল-কলেজে ল্যাব থাকলেও নেই প্রশিক্ষিত শিক্ষক বা প্রয়োজনীয় উপকরণ। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন যতটা উচ্চারিত হয়েছে, বাস্তবায়ন হয়েছে তার অনেক কম। এর পেছনে একদিকে বাজেট ঘাটতি, অন্যদিকে দুর্নীতিপরায়ণ আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা ও অবহেলা দায়ী।একটি জাতির প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নির্ভর করে মেধা ধরে রাখার ওপর। কিন্তু বাংলাদেশে মেধাবীরা প্রতিনিয়ত বিদেশে চলে যাচ্ছেন উচ্চ শিক্ষা, গবেষণা কিংবা চাকরির আশায়। কারণ দেশে তাদের জন্য যথেষ্ট সুযোগ নেই। যারা থেকে যান, তাদেরও অনেকেই বাধা-বিপত্তির মুখে কাজ করতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়েন। ফলে প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ যেমন তৈরি হচ্ছে না, তেমনি যে সামান্য আছে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অনুপ্রেরণার অভাবে।
এ অবস্থার পরিবর্তন আনতে হলে কেবল বাজেট বাড়ালেই হবে না, দরকার মানসিকতা ও রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারের পরিবর্তন। প্রযুক্তি খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, গবেষণার জন্য স্বাধীনতা এবং মেধাকে মূল্যায়নের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। প্রতিরক্ষা খাতকে কেবল অস্ত্রের বাহার নয়, বরং কৌশলগত জ্ঞান ও প্রযুক্তির আধার হিসেবে দেখতে হবে। প্রশাসনে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে না পারলে কোনো খাতেই দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন হবে না।
✍️
আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ
(শিক্ষার্থী: ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ)
প্রকাশক ও সম্পাদক : শিব্বির আহমদ রানা, ফোন নম্বর: ০১৮১৩৯২২৪২৮, 𝐄-𝐦𝐚𝐢𝐥: 𝐛𝐚𝐧𝐬𝐡𝐤𝐡𝐚𝐥𝐢𝐬𝐚𝐧𝐠𝐥𝐚𝐩@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦
অস্থায়ী ঠিকানা: স্মরণিকা প্রিন্টিং প্রেস। উপজেলা সদর, জলদী, বাঁশখালী, পৌরসভা, চট্টগ্রাম
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত